ফ্ল্যাশ মেমোরির বিকল্প হিসেবে মেমোরির ভূবনে আসতে যাচ্ছে যত বিপ্লব

বেশিদিন আগের কথা না, আপনি যদি বলতেন, আপনার সম্পূর্ণ মিউজিক কালেকশন দু আঙুলের মধ্যে ধরে রাখা যায় এমন একটা ডিভাইসের মধ্যে আটকানো যাবে তাহলে আপনাকে নিয়ে হয়তো পরিহাস করতো সবাই। একই ঘটনা যদি আপনি বলতেন, আপনার কম্পিউটারের সমস্ত ফাইলকে একটা চাবির রিং আকৃতির একটি মেমোরির মধ্যে ভরে রাখা যাবে, অথবা পকেট সাইজের একটা ক্যামেরার মধ্যে সংরক্ষণ করা যাবে হাজার হাজার হাই রেজুলেশনের ছবি।তাহলেও হয়তো আপনি উপহাসের পাত্র হতেন। অথচ মাঝখানে খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয় নি, এখন এসব কথা বললে আপনাকে নিয়ে কেউ ঠাট্টা মশকরা করবে বলে মনে হয় না।


ফ্ল্যাশ নামের একটি মেমোরি প্রযুক্তির অবিশ্যাস্য উন্নতির কারণে অল্প যায়গায় এখন অনেক বেশি ডাটা রাখা সম্ভব হয়েছে। আর ফ্ল্যাশ মেমোরি এখন এতটাই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, সেটিকে হটিয়ে নতুন কোন মেমরি মানুষের মনে জায়গা করে নেয়াটা খুব একটা সহজ হবে না। তাই বলে অগ্রগতি বা উন্নয়নের ধারাও তো থেমে নেই বা থাকবে না। বর্তমানে মেমোরি চিপস্‌ এর বাজার মূল্য ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার। তাই এই খাতে নতুন কোন আইডিয়া নিয়ে আসার মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের অভাব হবে না। তো আসুন, দেখা যাক আগামী দিনে আসতে যাচ্ছে কোন কোন মেমোরি, যা হয়তো ফ্ল্যাশের উত্তরাধিকারী হয়ে মাতাবে আগামী বিশ্বকে।

এমর‌্যাম (MRAM)


ফ্ল্যাশ মেমোরির অগ্রযাত্রার পথে বহুদিন ধরেই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাগনেটোরেজিস্টিভ র‌্যানডম অ্যাকসেস মেমোরি বা এমর‌্যাম। ১৯৯০ এর দশক থেকে বেশ কয়েকটি কম্পানি এমর‌্যাম প্রযুক্তির বিকাশে কাজ করে আসছে। এমর‌্যাম চিপ চৌম্বক উপাদানের দুটি পাতলা লেয়ারের মধ্যে ডাটা সংরক্ষণ করে। এখানে প্রতিটি লেয়ারই অনেকগুলো সেলে বিভক্ত। এরমধ্যে একটি লেয়ার হচ্ছে স্থায়ী ভাবে চৌম্বকয়িত, যার চৌম্বকায়নের গতিপথ কখনোই পরিবর্তিত হয় না। আর অন্যটি হচ্ছে সাময়িক চুম্বক, যার চৌম্বকায়নের মাত্রাকে ছোট একটি চৌম্বক ক্ষেত্র বা ইলেকট্রিক সার্কিট ব্যবহার করে ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত পাল্টানো যেতে পারে। এই দুই লেয়ারের চৌম্বকায়নের আপেক্ষিক অবস্থাই ঠিক করে দেয় একটা বিট ১ নাকি ০ তে সেট করা আছে। চৌম্বকায়নের এই ব্যবহারই একই সংগে এমর‌্যামের শক্তি ও দূর্বলতা। শক্তি, কারণ চৌম্বকায়ন খুবই দ্রুতগতির এবং এটিকে নিয়ন্ত্রন করাও সহজ। এর ফলে মাত্র এক ন্যানোসেকেন্ড সময়ে মেমোরিতে ডাটা রিড/রাইট করা যায়। আর এটা একটা দূর্বলতাও, কারণ একটা সেলে চৌম্বকায়নের পরিবর্তন করা হলে তা আশেপাশের সেলেও প্রভাব ফেলে। এমর‌্যাম প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা এগিয়ে চলছে বটে, তবে চৌম্বকায়নের ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলি বিজ্ঞানীরা এখনো দূর করতে পারে নি। এ সমস্যাটি এমর‌্যামকে বর্তমানে ৩২ মেগাবাইটের মাঝেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। যা কিনা বর্তমানের সেরা ফ্ল্যাশ ডিভাইসের ক্ষমতার প্রায় এক হাজার ভাগের এক ভাগ। তোশিবা এবং হিটাচি এমর‌্যাম প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাদের এই প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হবে তা সময়ই বলে দেবে।

ফের‌্যাম বা এফইর‌্যাম (FeRAM)

ফেরোইলেকট্রনিক র‌্যানডম অ্যাকসেস মেমোরি বা ফের‌্যামকে ফ্ল্যাশের নিকট আত্মীয়ই বলা চলে। ফ্ল্যাশের মতই এটিও বৈদ্যুতিক ইফেক্ট ব্যবহার করে ট্রানজিস্টর সদৃশ্ একটি কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে মুক্ত ইলেকট্রনের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রন করার বদলে এটি ব্যবহার করে বিশেষ ধরনের ক্রিস্টালে প্রাপ্ত ইলেকট্রনিক চার্জকে, যা ফেরোইলেকট্রনিক্স নামে পরিচিত। ফেরোইলেকট্রনিক্সকে ছোট, বহিঃস্থ ইলেকট্রিক ফিল্ড ক্রিস্টালের পজেটিভ ও নেগেটভ চার্জ করা আয়নকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে তাদের স্থান পরিবর্তন করতে পারে। এর ফলে সৃষ্ট হয় এক ধরনের ধারাবাহিক , সামাঞ্জস্যপূর্ণ পোলারাইজেশনের। উর্ধমুখি ও নিম্নমুখী পোলারাইজেশনই হচ্ছে ফেরোইলেকট্রিক বিটের ১ এবং ০। ক্রিস্টালে অল্প একটু ভোল্টেজ প্রবাহিত করার মাধ্যমে এত বারতি চার্জ প্রয়োগ করা যায়। ফলে পোলারাইজেশন পাল্টে যায়, সাথে সাথে পালটে যায় বিটগুলোও। এ প্রক্রিয়া সংগঠিত হতে সময় লাগে এক ন্যানোসেকেন্ডেরও কম, এবং শক্তিও লাগে খুব কম। এই দুটোই হচ্ছে ফের‌্যামের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। তবে এর কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। আর সবচেয়ে বড় দিক  হল, এটি চার্জ ভিত্তিক। একে সর্বোচ্চ কার্যক্ষম করতে হলে এর কাছাকাছি কোথাও বাড়তি চার্জ স্থাপন করতে হবে। আর এ কারণে প্রতিটি ফের‌্যাম সেলের সঙ্গে আলাদা করে একটা ক্যাপাসিটর যোগ করে দিতে হয়। ফলে অনর্থক অনেক বেশী জায়গা নষ্ট হয়। এ কারণ্ ফের‌্যাম ফ্ল্যাশের মত গিগাবাইট পর্যায়ে যেতে পারবে না বলে মনে করেন অনেক গবেষক। তবে শক্তি অনেক কম খরচ করে বিধায় এর গ্রহণযোগ্যতাও আছে। আর এ কারণেই হয়তো তোশিবার মত কোম্পানি এর পিছনে এত অর্থ ও শ্রম ব্যায় করে চলছে। ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারিতে তারা ফের‌্যামের একটা প্রোটোটাইপ উদ্ভাবন করে, যার ধারণ ক্ষমতা ছিল ১২৮ মেগাবাইট।

পিসির‌্যাম (PCRAM)

ফেজ চেঞ্জ অ্যাকসেস মেমোরি বা সংক্ষেপে পিসির‌্যাম। রিরাইটেবল সিডি বা ডিভিডিতে যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় পিসির‌্যামের প্রযুক্তি অনেকটা সে রকমই।পিসির‌্যাম তথ্যকে সংরক্ষণ করে উপাদানের পারমানবিক কাঠামোতে, দুটো ভিন্ন পর্যায়ে। একটি হচ্ছে নির্দিষ্ট আকারবিহীন বা অনিয়তকার ফেজ, যেখানে পরমাণুগুলোকে নির্দিষ্ট কোন ধরনে বিন্যস্ত করা হয় না, আর অন্যটি হচ্ছে শৃঙ্খলাবদ্ধ, স্ফটিকায়িত ফেজ। ইলেকট্রডের উপর লেজার রশ্মি বা বিদ্যুৎ প্রবাহিত করার মাধ্যমে দুই ফেজের অবস্থান পালটানো হয়। তবে এ কথা সত্য যে, পিসির‌্যামও সমস্যা মুক্ত নয়। মেমোরি উপাদনকে কয়েকশ ডিগ্রী উপাদানে উত্তপ্ত করার জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। তবে ডিভাইসটি আকারে যত ছোট হবে শক্তির পরিমাণও তত কমতে থাকবে। অনেক গবেষক মনে করেন পিসির‌্যাম প্রযুক্তিতে মাত্র ৫ ন্যানোমিটার প্রস্থের মেমোরি ইউনিট তৈরী করা সম্ভব। যদিও এটি ফ্ল্যাশ মেমোরির সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার ১০ ভাগের ১ ভাগ হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানই পিসির‌্যামের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে স্যামসাং অন্যতম। সম্রতি তারা ৫১২ মেগাবাইট ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটি পিসির‌্যাম মেমোরি চিপ উদ্ভাবন করেছে।

আরর‌্যাম (RRAM)

পিসির‌্যামের পাশাপাশি রেজিসটিভ র‌্যানডম অ্যাকসেস মেমোরি বা আরর‌্যাম নামের আর একটি প্রযুক্তিও অত্যন্ত ক্ষুদ্র পর্যায়ে ব্যাপক সম্ভাবনা জাগিয়েছে। আরর‌্যাম নির্ভর করে ইলেকট্রোক্যামিক্যাল রিয়াকশনের উপর, যে প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু স্ফটিকায়িত  বস্তুর বন্ধন কাঠামোকে পাল্টে দেয়। আরর‌্যামের মূল উপাদান হচ্ছে এক ধরনের প্রাকৃতিকভাবে অন্তরিত অক্সাইড। উপরেল্লেখিত স্ফটিকে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হলে স্ফটিকের সঙ্গে অক্সিজেন পরমাণুকে আটকে রাখে যে ইলেকট্রন বন্ধন, তা ভেঙে যায়। আর তখন স্ফটিক থেকে বিচ্ছিন্ন অক্সিজেন স্ফটিকের গায়ে রেখে যায় অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র ও বাড়তি কিছু ইলেকট্রন। এসব ছিদ্র সাধারণত সারিবদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং ছিদ্রের এই সারি স্ফটিকের গায়ে সৃষ্টি করে অত্যন্ত সংকীর্ণ , বিদ্যুৎ পরিবাহী কিছু চ্যানেলের। ভোল্টেজকে উল্টে দিলে অক্সিজেন অ্যাটম এই চ্যানেলের মধ্য দিয়ে আগুপিছু করতে থাকে এবং স্ফটিককে একটি অন্তরিত অবস্থার মধ্যে বারবার নিয়ে যায়।এই রিভার্সেবল ট্রানজিসন সাঞ্জস্যপূর্ণ একটি মেমোরি অবস্থা তৈরি করে যাকে কেবলমাত্র সঠিক পোলারিটি-সমৃদ্ধ উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমেই পরিবর্তন করা যায়। এই অবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমেই কনডাকশন অন এবং অফ করার মাধ্যমেই কাজ করে আরর‌্যাম। এইচপি সহ বিশ্বের খ্যাতনামা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আরর‌্যাম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এতে শক্তি অনেক কম লাগে বলে এটি বিজ্ঞানীদের আগ্রহ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। 


মন্তব্যসমূহ